চিন্ময় চীন: এইটা আবার কেমন বই?


 

Cover 01.jpg

আমাকে ১ টাকার একটা নোট দেবেন একটি ভালো বইয়ের সন্ধান দেওয়ার জন্য।

এতোদনি জানতাম বাইরের আক্রমণ থেকে চীনকে রক্ষা করতে চীনের মহাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু চিন্ময় চীন পড়ে জানতে পারলাম- “চীনের দক্ষিণাঞ্চলকে উত্তরাঞ্চলের মানুষের আক্রমণ থেকে বাঁচাতেই এই প্রাচীর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কারণ চীনের দুই অংশ একে অপর থেকে আলাদা ছিল। দক্ষিণাঞ্চল কৃষিপ্রধান; আবহাওয়া উষ্ণ। অন্যদিকে উত্তরাঞ্চল শীত প্রধান। ঠাণ্ডা আবহাওয়া হওয়ার কারণে উত্তরাঞ্চলের লোকজনের মূল পেশা ছিল পশুপালন। তাই কৃষিপণ্যের জন্য দক্ষিণাঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল ছিল উত্তরাঞ্চলের মানুষ। তারা প্রায়ই দক্ষিণাঞ্চলে লুঠতরাজ চালাতো। দুই পক্ষে লড়াই চলতো। এদিকে কৃষিকাজের জন্য দরকার স্থিতিশীল পরিবেশ। এমনি এক প্রেক্ষাপটে মহাপ্রাচীর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ১ লাখ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মহাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল। এখন এর মাত্র ৬,৭০০ কিলোমিটারের মতো অংশ টিকে আছে, তার মধ্যে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের উত্তরাঞ্চলের ৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ অংশটুকু বেশি সুরক্ষিত।  প্রতিবছর যে কয়েক কোটি পর্যটক মহাপ্রাচীর দেখেন সেটি মূলত বেইজিংয়ের পাতালিং অঞ্চলের অংশ। মহাপ্রাচীরের এই অংশটুকু নির্মিত হয়েছিল ১৫০৫ সালে মিং রাজবংশ আমলে। এখানকার মহাপ্রাচীরের উচ্চতা গড়ে ২৫ ফুট। আর প্রস্থে ১৩ ফুট।

চিন্ময় চীন বইয়ে এমন আরো চমকপ্রদ ও ইতিহাসের অজানা সব পাঠ আছে, যা সচরাচর কোন বইয়ে পাওয়া যায় না। যারা চীন বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবছেন তারা তো বটেই যারা চীনে না গিয়েও চীন সম্পর্কে জানতে চান তাদের জন্য এই বইটি রেফারেন্স বই হিসেবে কাজ করতে পারে। তবে যারা “সেলফি পর্যটক” কিংবা কতো জায়গায় গেলাম সেই তালিকা বানাতেই পছন্দ করেন, তাদের মনে হতে পারে এই বই পড়ে সময় নষ্ট করার দরকার কী? আমি বলব বরং তাদের জন্য এই বই সংগ্রহ করা “আবশ্যক”। কেন জানেন? ছবির ক্যাপশন লিখতে কিংবা বন্ধুদের তাদের জ্ঞান দিয়ে চমকে দিতে এই বইটি তাদেরকে অনেক বেশি সাহায্য করবে। এই বইটি খুবই অথেনটিক একটি বই। এই বইয়ের কোন তথ্যই ভুল নয়। কারণ বইটি লিখেছেন চীন আন্তর্জাতিক বেতারের দুই সাংবাদিক। একজন হলেন কে এম আলিমুল হক, যিনি চীন আন্তর্জাতিক বেতার (সিআরআই)-এর বাংলা বিভাগের সম্পাদক। অন্যজন একই বিভাগের উপ-পরিচালক ছাই ইয়ান হুয়া। বইয়ের লেখকদ্বয় চীনের ১৩০ কোটি মানুষকে বইটি উত্‌সর্গ করে লিখেছেন- যাদের ত্যাগ ও পরিশ্রমে বিশ্বমঞ্চে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়েছে চিন্ময় চীন।

ম্যাট পেপারে চমত্‌কার ছাপা ও বাধাইয়ের ২১৫ পৃষ্ঠার বইটিতে ২০০ এর বেশি ছবি আছে। রঙিন সেসব ছবি লেখার মতোই জীবন্ত! ৯টি অধ্যায়ে বিভক্ত বইটি ইচ্ছে করলে একটানা পড়ে শেষ করা যায়। কিন্তু আমার মনে হয় আপনার সেটি করতে ইচ্ছে করবে না। কারণ বইটি অধ্যায়গুলোর অনেক বর্ণনাই আপনার মধ্যে আরো জানার আগ্রহ তৈরি করবে। আর সেই সুবাদে আপনি গুগল করে এটা ওটা জানতে থাকবেন। আগেই বলেছি এটা শুধু একটা ভ্রমণ বিষয়ক বই নয়, তারচেয়ে অনেক বেশি কিছু। যেমনটা এর লেখকদ্বয় বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন: “চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা বিভাগের একটি অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘চলুন বেড়িয়ে আসি’। পর্যটনবিষয়ক এই অনুষ্ঠানটি প্রায় দু’বছর আমরা দু’জন শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরার কাজ করেছি। বস্তুত, ওই অনুষ্ঠান করতে গিয়েই আমরা সুন্দর চীনকে যেন আরও বিশদভাবে আবিষ্কার করি। সেই জানাশোনাই আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছে এই গ্রন্থটি রচনা করতে।“ তারা আরো লিখেছেন “পর্যটনবিষয়ক বই মানেই প্রচুর তথ্যের সমাহার। আমরা চেষ্টা করেছি বইটিকে তথ্য-ভারাক্রান্ত না করতে। আবার প্রয়োজনে কখনও কখনও তথ্যের আড়ালের তথ্য দিতেও কার্পণ্য করিনি।“

ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় চীনের অবস্থান দ্বিতীয়। চীনের ৫৩টি স্থানকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সবগুলোর তালিকা এই বইয়ে দেওয়া আছে। আর ২৫টি বিশ্ব ঐতিহ্যের বর্ণনা বিশদভাবে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি বিশ্ব ঐতিহ্যের বর্ণনা পড়ে আপনার ইচ্ছে করবে একবার ঘুরে দেখে আসতে। আবার কোন কোনটির বর্ণনা পড়ে আপনার মনে হতে পারে “এমনটা তো আমাদের দেশেও হতে পারত”। যেমন ধরুন তুচিয়াংইয়ান জলসেচ-ব্যবস্থা।  যিশু খৃষ্টের জন্মের ২৭৬ বছর আগে নির্মিত এই জলসেচ ব্যবস্থা বিশ্বের প্রাচীণতম, এবং এখনো চালু আছে। সেই যুগে সেচ-প্রকৌশলী লি পিং একদিকে ছিন রাজ্যের অধিবাসীদের ফি বছরের বন্যার কবল থেকে বাঁচাতে এবং অন্যদিকে নদীর অতিরিক্ত পানি ছেংতুয়ের শুষ্ক অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত করতে মিন নদীতে একটি কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তখন না বারুদ আবিষ্কৃত হয়েছে না ছিল পাথর কাটার কোন আধুনিক যন্ত্রপাতি। তিনি আগুন ও পানি ব্যবহার করে পাথরকে গরম ও ঠাণ্ডা করার মাধ্যমে ফাটানোর পদ্ধতি ব্যবহার করে দীর্ঘ ৮ বছরে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে একটি কুড়ি মিটার দীর্ঘ চ্যানেল তৈরি করেন। এছাড়াও নদীর মাঝখানে মাছের মুখের আকৃতির একটি কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ করেন। একাজে ৪ বছর সময় লেগেছিল। পুরো সেচ ব্যবস্থাটি চালু হওয়ার পর এই অঞ্চলে আর বন্যা হয়নি এবং শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব হয়নি।  তুচিয়াংইয়ান সেচ ব্যবস্থা আধুনিক সেচ বিজ্ঞানীদের কাছেও একটি বড় বিষ্ময়।

এই বইয়ে বিষ্ময়কর প্রাচীণ আবাসিক ভবন থুলৌ-র ছবি ও বর্ণনা পাওয়া যাবে। মানুষ তার প্রয়োজনে কীভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে বাস করে এবং নিজেদের রক্ষা করে তারই এক অনুপম নিদর্শন হলো থুলৌ। ধানক্ষেতও যে দেখার মতো বিষয় হতে পারে সেটি বইয়ের ৮১ নাম্বার পৃষ্ঠায় পাওয়া যাবে হোংহ্য হানি ধানক্ষেতের ছবিতে। খুলাংছুর গল্প পড়লে সংস্কৃতিমনা প্রত্যেকেই একবার যেতে চাইবেন ২ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপটিতে। ছোট এই দ্বীপে ১৩টি দেশের নিজ স্টাইলের কনস্যুলেট আছে। এটিই চীনের একমাত্র ‘আন্তর্জাতিক দ্বীপ’।

বইয়ে ২৫টি ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যের বর্ণনা ছাড়াও পর্যটকদের জন্য কয়েকটি প্রদেশের বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। সেসঙ্গে চীনে গেলে কী খাবেন সেটি জানানো হয়েছে চীনের খাবার অধ্যায়ে। চীনের ৫৬ জাতি সম্পর্কে একটি আলাদা অধ্যায় আছে। চীনের প্রধান চারটি উত্‌সব ছাড়াও ছোট বড় আরো কয়েকটি উত্‌সবের ছবি ও বর্ণনা দেওয়া আছে বইয়ের ১৩৫ থেকে ১৪৪ পৃষ্ঠার মধ্যে।  এছাড়াও লেখক আলিমুল হকের প্রাঞ্জল বর্ণনায় উঠে এসেছে চীনের বিভিন্ন শহর ও গ্রামে তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। পড়তে পড়তে মনে হবে আপনি নিজেই বোধহয় লিখেছেন। যারা ইতোমধ্যে চীন গিয়েছেন আমি বাজি ধরে বলতে পারি এই বইয়ে তাদের জন্যও নতুন কিছু জানার তথ্য আছে। যা তারা পরের বার চীন গেলে সচক্ষে দেখে আসতে পারবেন। মিলিয়ে নিতে পারবেন।

আমি বাংলাদেশের অন্তত ৬০০ ইউনিয়নে সশরীরে গিয়ে কাজ করেছি। হাজারেরও বেশি গ্রামে গিয়েছি। চিন্ময় চীনে লেখা “চীনের সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম হাও থাং” এর বর্ণনা পড়ার মনে হয়েছে একদিন আমাকেও লিখতে হবে আমাদের দেশেও এমন সুন্দর গ্রাম আছে। আমি #rebuildBangladesh নামে একটি হ্যাশট্যাগ আন্দোলন করি। এছাড়াও রাজনীতি শেখার পাঠশালা এবং একাত্তরের জানালা নামে দু’টো ফেসবুক পেইজ মডারেট করি। আমার বিশ্বাস একদিন আমার ও আমার মতো আরো হাজারো বাংলাদেশী মিলে আপনাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় চীনের হাও থাং গ্রামের মতো সুন্দর সুন্দর গ্রাম আমাদের এখানেও গড়ে উঠবে। যে গ্রামের শিশুদের জন্য দৃষ্টিনন্দন স্কুল, খেলার মাঠ আর সবুজ অরণ্য আছে। চিন্ময় চীন আমাকে আরো বেশি দেশকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। আমি জানি এই বই পড়লে আপনার মধ্যেও দেশের জন্য আরো বেশি কাজ করার অনুপ্রেরণা তৈরি হবে। আর বেশি কিছু বলব না। নিচে বইটির লেখক প্রকাশক ও প্রাপ্তি স্থানের কথা বলা হলো। সেসঙ্গে দামটাও জানানো হলো। বইটি পড়ার পর আপনার প্রতিক্রিয়া জানাতে ভুলবেন না। আর আমাকে এক টাকা দেবেন একটি ভালো বইয়ের সন্ধান দেওয়ার জন্য।

 

চিন্ময় চীন
লেখক:
আলিমুল হক ও ছাও ইয়ান হুয়া
প্রথম প্রকাশ: অক্টোবর ২০১৮
প্রকাশক:  কালার ক্রিয়েশন
পরিবেশক:  জাদুর কাঠি

পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২১৫
দাম: ৪০০ টাকা (১৫ শতাংশ কমিশনে বিক্রি করা হচ্ছে।)
প্রাপ্তিস্থান: রকমারি ডট কম (https://www.rokomari.com/book/174038/chinmoy-chin–mat-paper-); পাঠক সমাবেশ; বাতিঘর ও পিবিএস

 

মোহাম্মদ গোলাম নবী
১৫ নভেম্বর ২০১৮
পল্লবী। ঢাকা।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান