লেজার প্রিন্টারের টোনার এবং ৫০০ টাকার জাল নোট


লেজার প্রিন্টারের টোনার

গতকাল রাত সাড়ে এগারোটায় প্রিন্টারের কালি ফুরিয়ে গেলো। আমি জানতাম প্রিন্টারের কালি যেকোন সময় ফুরাবে। সেকারণেই ৩% কালি থাকতেই একটা টোনার কিনে রেখেছিলাম, যাতে প্রয়োজনের সময় সমস্যায় পড়তে না হয়। কিন্তু বিধাতা যদি না চায়, আপনি চাইলেও ঠেকাতে পারবেন না।
যাই হোক প্রিন্টারের পাশে রাখা কাগজের ব্যাগ থেকে নতুন টোনারের বাক্সটা বের করলাম। খুলতে গিয়ে দেখি সিল আগেই কাটা। বিষ্ময় অপেক্ষা করছিল আরো। বক্স কার্টুনের মুখ খুলতেই দেখি ভেতরে কালো রংয়ের প্লাস্টিকের ব্যাগের মুখ ছেড়া। প্রাস্টিকটা বক্স কার্টুনের মধ্য থেকে বাইরে এনে ওর ভেতর থেকে টোনারটা বের করলাম। মনে প্রশ্ন জাগল, প্লাস্টিকটা ছেড়া কেন? টোনারের সঙ্গে লাগানো কমলা রংয়ের প্লাস্টিকের ঢাকনা খুলে দেখি ঢাকনার ভেতরের দিকে অল্পবিস্তর কালি দেখা যাচ্ছে। যা অস্বাভাবিক। প্রথমেই মনে হলো, এটা হতে পারে না। অসম্ভব একটা ব্যাপার কারণ আমি যেখান থেকে টোনার কিনেছি তারা কোনমতেই আমাকে ব্যবহৃত কিংবা পুরনো টোনার দিতে পারে না। অবিশ্বাস থেকেই প্রিন্টারে টোনারটা লাগালাম। ধরেই নিয়েছি, কালি ১০০% দেখাবে। কিন্তু না কালি দেখাচ্ছে ০%; এবার আমার সত্যি সত্যি খারাপ লাগতে শুরু করল। তবে বিশ্বাস হারালাম না। কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে। ভাবলাম হয়তো প্রিন্টারেই ঠিক দেখাচ্ছে না। আবার নিজের কাছেই সেটা যুক্তিযুক্ত মনে হলো না। কাগজের ব্যাগের মধ্যে রায়নস কমপিউটার্সের বিলের খামটা দেখা যাচ্ছে। হাতে নিয়ে দেখি বিলের কাগজে টোনারের সিরিয়াল নাম্বার দেয়া আছে। বাক্সের সিরিয়ালের চেয়ে একটি অক্ষর বেশি আছে বিলের সিরিয়ালে। আর বিলের সিরিয়াল নাম্বারের সঙ্গে মিল আছে কালো প্লাস্টিকের গায়ে লাগানো সাদা টুকরো কাগজে লেখা সিরিয়াল নাম্বারের।

মনে মনে ভাবলাম, তারমানে কি বিল করার সময় কাগজের বাক্স থেকে কালো প্লাস্টিকের ব্যাগটা বের করে সিরিয়াল লেখা হয়েছিল? আর সেকারণে বক্সের মুখ খোলা? যুক্তি খুঁজছি নিজেই। পরের প্রশ্নটা মনে এলো- প্লাস্টিক ছিড়ে টোনার বের করা হয়েছিল কেন? টোনারটা উল্টে পাল্টে দেখতে গিয়ে দেখি টোনারের গায়ে লাগানো আরেক টুকরো সাদা কাগজে সিরিয়াল নাম্বার লেখা। এবার মিলাতে গিয়ে দেখি সিরিয়াল নাম্বার আর মিলছে না।

এতক্ষণে নিশ্চিত হলাম, টোনারটা বদলে দেয়া হয়েছে? কখন সেটা করা হলো? কে করল? আমার মনের মধ্যে নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল।

মনে হলো পারলে এখনই একবার জুয়েল ভাই (রায়ানসের মালিক) এর সঙ্গে কথা বলা দরকার। উনি রাত জাগেন। কিন্তু আজকে কি জেগে আছেন? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে তাকে ফোনে এসএমএস পাঠালাম। উনি ফোন করলেন। কথা হলো। তিনি টোনার ও বিলের কাগজ নিয়ে আজকে (১৫ নভেম্বর ২০১৩) রায়ানসে যেতে বললেন।

আজকে রায়ানসে গেলাম। রায়ানসের বিপ্লব ভাই পুরো ঘটনাটি শুনলেন। যারা টোনার আমদানীকারক তাদের প্রতিনিধিকে ডাকা হলো। তিনিও শুনলেন।
বিপ্লব ভাই আমাকে আমদানীকারকের প্রতিনিধির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় যে কথাটার উপর জোর দিলেন তাহলো- জুয়েল ভাই (আমি) একটা স্ক্রু দরকার হলেও আমাদের এখান থেকে কেনেন।

বেশ কিছুক্ষণ আলাপ হলো। কিভাবে এটা হতে পারে সেনিয়ে বিভিন্ন ধরনের গল্প হলো। জানলাম, কিভাবে লোকজন নিজেরাই টোনার বদলে এসে ক্লেইম করে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

এরিমধ্যে আমার জন্য নতুন একটা টোনার আনানো হলো। বিপ্লব ভাই শুধু একবার বললেন, শুধু আপনি বলেই এটা চেঞ্জ করে দেয়া হলো।
আমাকে কেনো? অন্যতম কারণটি হলো, দীর্ঘদিনের ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক।

দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ফলে কিভাবে আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি হয় তেমন আরেকটি ঘটনা তখন আমি তাদেরকে বললাম। পাঠক সেটা আপনাদেরকে জানানোর আগে টোনার কেনার টিপস দিতে চাই। যদিও সম্পর্কের কারণে আমি টোনার ফেরত পেয়েছি কিন্তু বিষয়টি আমার কাছে খুবই নাজুক একটি বিষয় মনে হয়েছে। যা এড়ানোর সুযোগ থাকলে সেই সুযোগ সবার নেয়া উচিৎ। আমি নিজেও ভবিষ্যতে যেটা করব। আমি টোনার কেনার সময় দেখে নেব। এজন্য যা করতে হবে সেটি খুব সিম্পল। টোনারের বিল পরিশোধ করার পর দোকানে বসেই কাগজের প্যাকেট খুলে প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করতে হবে, এরপর সেই প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে টোনার বের করে সবগুলো সিরিয়াল নাম্বার মিলিয়ে নিতে হবে। তাহলে আর সমস্যায় পড়তে হবে না। এটা শুধু টোনারের বেলায় নয়। আমি মনে করি সব ধরনের পণ্য কেনার পর দেখে নেওয়াটাই উত্তম। আমি নিজেও ভবিষ্যতে এটাই করব। এবার চলুন আমার অন্য একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি।

জাল নোট

এটিএম মেশিন থেকে তোলা টাকা থেকে একটা ৫০০ টাকার নোট গুলশান আড়ংয়ে দেয়ার পর তারা বলল নোটটি নকল। আমাকে সেটা দেখালোও। তারপর নোটটি পাঞ্চ মেশিন দিয়ে ফুটা করে দেয়া হলো।

কষ্টে উপার্জিত সৎ পয়সা এভাবে নষ্ট হওয়ায় খুবই খারাপ লাগতে লাগল। পরদিন সেই নোটটা নিয়ে হাজির হলাম এগারো নাম্বারে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকে। ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে ঘটনা বললাম। তাকে নোটটাও দিলাম। আমি তাকে একথাও বললাম যে, আমি ১৯৯৯ সাল থেকে তাদের ব্যাংকের গ্রাহক। আর আমার অন্য কোন ব্যাংকে একাউন্ট নেই। তিনি আমার একাউন্ট নাম্বার জানতে চাইলেন। কমপিউটারে আমার একাউন্টে ঢুকলেন। এরপর কোথাও এক জায়গায় ফোন দিলেন। আমি এপাশ থেকে শুনছি তিনি বলছেন, আমাদের এতো পুরনো একজন কাস্টমার, গ্রীন্ডলেজ আমলের…… আমি মনে করি তিনি সত্যি বলছেন…….

ফোন রেখে তিনি ক্যাশ থেকে ৫০০ টাকার একটা নোট এনে আমাকে দিলেন। আমি অভিভূত হয়েছিলাম সেদিন। আজকে টোনার ফেরত পেয়েও আমার ভালো লেগেছে।

শেষ কথা

দু’টি ঘটনাই ব্যতিক্রম। কিন্তু এই দু’টো ঘটনা থেকে আমার সিদ্ধান্ত হলো সম্পর্কের একটি দাম আছে। সততার দাম আছে। সততার সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে নেওয়ার দাম আছে। দাম কথাটি আমি ইচ্ছে করেই তিনবার বললাম।

কেনাকাটা করার জন্য আমি পারতপক্ষে যতোদূর সম্ভব একই দোকান বারবার ব্যবহার করি। প্রয়োজন ছাড়া আমি দোকান বদলাই না। যেকারণে আমি যে দোকান থেকে সবজি কিনি তারা আমাকে বাছাই করা সবজি দেয়। আমি যে দোকান থেকে মাছ কিনি তারা আমাকে নষ্ট মাছ দেয় না। আমি যে দোকান থেকে ফল কিনি সে আমাকে নষ্ট ফল দেয় না। এই তো গত পরশুদিন আমি সফেদা নিতে চাইলাম দোকানদার আমাকে সেটা দিলো না। (আমার যদিও খারাপ লাগে ওই ফলটাই সে অন্য কাউকে দেবে। যা অনুচিত। আমি একটি শুদ্ধ সমাজের স্বপ্ন দেখি সেটা আরেক গল্প অন্য সময় বলব।)

সবসময় এক দোকান থেকে কেনার সুবিধা হলো সম্পর্কটা তৈরি হয়। আস্থাও জন্মে। ফলে, আমার মতো পরিস্থিতিতে পড়লে আপনি তার কাছ থেকে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা আশা করতে পারেন। যেমনটা আমি পেয়েছি।

ধন্যবাদ রায়ানস কমিপউটার্স। ধন্যবাদ স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান