মুনির হাসানের ডিমান্ড নোট বিক্রির গল্প, প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ এবং এক সন্ধ্যা


মুনির ভাই সেই গল্পটা আজকেও বললেন। ডিমান্ড নোট বিক্রির গল্প। গল্পটা মুনির ভাইয়ের ভাষায় এমন:

‘আশির দশকের কথা। আমরা যখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তখন আমাদের একটি বিশেষ বিনোদন ছিল খাওয়াদাওয়া। সেটি চায়নিজ, হাজির বিরিয়ানি বা নীরবের ভাজি-ভর্তা। টিউশনির টাকা, পত্রিকায় লেখার বিল বা বৃত্তির টাকা—অবধারিতভাবে আমাদের গন্তব্য কোনো রেস্টুরেন্ট। হিজ হিজ হুজ হুজ। এসবের মধ্যে আমাদেরই এক বন্ধু ১০০ টাকা জমলে একটি টেলিফোনের জন্য দরখাস্ত করত। যে সময়ের কথা বলছি, তখন বিটিটিবির (এখনকার বিটিসিএল) ফোনের অনেক চাহিদা। তারপর আমরা পাস করে বের হলাম। আমাদের পকেটে সুন্দর কাগজে জীবনবৃত্তান্ত। আর আমাদের ওই বন্ধুর কাছে বেশ কিছু ডিমান্ড নোট (টেলিফোনের বরাদ্দপত্র), ঢাকার বিভিন্ন স্থানের। মতিঝিলে তখন টেলিফোন সংযোগ অনেক টাকায় বিক্রি হয়। আমাদের সেই বন্ধুটি তার কয়েকটি ডিমান্ড নোট বিক্রি করে দিল—তাতে তার জোগাড় হয়ে গেল প্রাথমিক মূলধন। আমাদের ওই বন্ধুটি এখন একটি গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান! আমাদের সঙ্গে তার পার্থক্য ছিল শুরু থেকেই। নিজে কিছু একটা করবে ভেবেছিল, সে জন্য ছাত্রজীবনে প্রস্তুতি নিয়েছে এবং সম্পূর্ণ নিজের উদ্ভাবনী বুদ্ধিতে ব্যবসার পুঁজি জোগাড় করেছে।’

গল্পটা বলার সময় তিনি একথাও বললেন যে, জুয়েলের এই গল্পটিতে আপত্তি আছে।

জুয়েল আমার ডাক নাম। একসময় আমি গোলাম নবী জুয়েল নামে লেখালেখি করতাম। ১৯৮৭ থেকে ২০০৭ পরযন্ত সময়কালে যাদের সঙ্গে আমার পরিচয় তারা আমাকে জুয়েল নামেই বেশি চেনে। আমার পাঠকরাও আমাকে মূলত সেই নামেই চেনে। এবং ওই নামেই ডাকে। মুনির ভাইয়ের ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। মুনির ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় সম্ভবত ১৯৯৩ সালে। মুনির ভাইয়ের পুরো নাম মুনির হাসান। তিনি বিখ্যাত মানুষ। দেশের তরুণ তরুণীদের কাছে পরিচিত মুখ। অধ্যাপক জাফর ইকবালের পরে এই দেশে কিশোর-কিশোরী ও তরুণ তরুণীদের কাছে মুনির হাসানই সম্ভবত বেশি পরিচিত মুখ। অনেক কারণেই তিনি পরিচিত। তবে গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেই বোধকরি তার পরিচিতটা প্রসারিত হয়েছে। তো মুনির ভাইয়ের সঙ্গে আজ এক সন্ধ্যা কাটানোর সময় হয়েছিল। সেখানে আরো অনেক সফল মানুষের উপস্থিতি ছিল।

প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠন আয়োজন করেছিল ‘আধুনিক পেশাজীবি ও উদ্যেক্তা তৈরি’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভা। মুনির ভাই সেখানেই বলেছিলেন গল্পটি। সেসঙ্গে আমার আপত্তির বিষয়টি। তিনি সত্যিই বলেছেন। আমার আপত্তি আছে। আপত্তির মূল কারণটি হলো একটি অসৎ ও রাষ্ট্রীয় আইন ভঙ্গকে মুনির ভাই প্রমোট করছেন। তার উপর আস্থাশীল বিপুল সংখ্যক ছেলেমেয়ের প্রতি তার যে দায়িত্ব সেটিকে তিনি বিবেচনায় নিচ্ছেন না। তার একটি ভুল মেসেজ অনেক বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে সেটা তিনি হয়তো স্বীকার করেন না। উনার মতো বিখ্যাত মানুষদের মধ্যে এমন সমস্যা একটি সাধারণ সমস্যা। উনার চেয়ে যারা একধাপ বা কয়েক ধাপ বেশি জনপ্রিয় তারাও এমন ভুল করে যাচ্ছেন। আমি সবাইকে বলতে পারি না। যাদেরকে পারি তাদেরকে বলি। মুনির ভাই তাদের একজন। অন্যদেরকে কখনো সুযোগ পেলে বলে দেব!

আমি প্রায়ই একজন নেতার অন্যায় ও সাধারণ মানুষের অন্যায়ের তফাৎ বোঝানোর জন্য একটি কথা বলে থাকি। একজন ইমামের নারী ধর্ষণ ও একজন সাধারণ মানুষের নারী ধর্ষণের মধ্যে তফাত আছে।

আমি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-র অনেক নেতাকে বলতে শুনেছি পাঁচ বছর ভালো ভাবে খেয়ে নিতে পারলে বাকি জীবন আর চিন্তা করত হবে না। অনেক ঘুষখোর এভাবে যুক্তি দেয় হজ্ব করে সব কিছু ছেড়ে দেব। কিংবা একবার দুবার অন্যায় করলে কিছু হয় না। মুনির ভাইয়ের ডিমান্ড নোটের গল্পটি আমার কাছে ভিন্ন কিছু মনে হয় না।

একজন লোক সৎ কিনা সে কথাটি তখনই বলা যাবে যখন তিনি অসৎ হওয়ার সুযোগ থাকা সত্বেও সৎ থাকেন। যে লোকের ঘুষ খাওয়ার কোন সুযোগ নেই তিনি ঘুষ খান না সেটি উল্লেখ করার মতো বিষয় নয়। তার সততা পরিক্ষীত নয়। অপরাধ ছোট হোক আর বড় হোক অপরাধই। তবে জীবন রক্ষার্থে যখন কেউ অন্যায় করেন সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। যেমন একবার এক ঘেরের মালিক ঘেরের কাছে বসবাসরত এক পরিবারকে চোর সাব্যস্ত করে সালিশ বসালো। ওই ঘটনায় আমার বক্তব্য ছিলো ওই দরিদ্র পরিবারটি শুধুমাত্র তাদের খাবারের জন্য ঘেরের মাছ ধরেছে। তারা এটি বিক্রি করেনি। অতএব তারা কোন অন্যায় করেনি। সমাজের দরিদ্র মানুষের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের কিন্তু রাষ্ট্র যখন দুবৃত্তরা চালায় তখন সমাজের দরিদ্র মানুষের দায়িত্ব এলাকাভিত্তিক সম্পদশালীদের অনেকসময় নিতে হতে পারে। বিষয়গুলো যুক্তি দিয়ে বুঝতে হবে।

নির্বাচন কমিশন যখন এমপি সাহেবের নির্বাচনী খরচের হিসাব বেধে দেওয়া সীমার মধ্যে রাখাটা নিশ্চিত করতে পারেন না তখন নির্বাচনী আইন ভঙ্গকারী এমপি সাহেব আরো বড় ধরনের অপরাধে লিপ্ত হন। সমাজের বিত্তশালী ও সুবিধাভোগী মানুষগুলো যখন অপরাধ করার সুযোগ পায় ও অপরাধ করে তখন একসময় অপরাধ করাটা তাদের কাছে ডালভাত হয়ে যায়।

মুনির ভাইয়ের সেই বন্ধুটিও রাষ্ট্রীয় আইন ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে যে পুঁজি সংগ্রহ করেছেন সেই ধারাবহিকতা পরবর্তীতে তিনি বজায় রেখেছেন। সেটা আইসিটি সেক্টরের অনেকেই জানেন। মুনির ভাইও নিশ্চয়ই জানেন। মানুষের জীবন খণ্ডিত হতে পারে না। একজন মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পরযন্ত পুরোটাই তার জীবন ও তাকে তার সারাজীবনের কাজের ভিত্তিতেই মূল্যায়ন করতে হবে। একটা মানুষ যতোটা পথ পেরিয়ে এসেছেন তাকে পুরোটা ধরেই মূল্যায়ন করতে হবে। এটা মুনির ভাইয়ের জন্য যেমন সত্য। আমার জন্যও সত্য। তার সেই বন্ধুর জন্য সত্য। অধ্যাপক জাফর ইকবালের জন্য সত্য। হাসিনা, খালেদা, যদু, মধু সবার জন্য সত্য। একসময় কেউ একটা ভালো কাজ করেছেন বলে সেটা তার খারাপ কাজ করার সার্টিফিকেট হতে পারে না। যেমন, ড. কামাল হোসেন সংবিধান রচনা করেছেন বলে তিনি বিদেশী তেল কোম্পানির দেশ বিরোধী কর্মকান্ডের পক্ষে সাফাই গাওয়ার অধিকার অর্জন করেননি। একটা মানুষের ভালো থাকাটা সারা জীবনের বিষয়।

মুনির ভাইকে নিয়ে অনেকক্ষণ কথা হলো। শেষ কথাটি বলি, আমি আশা করব মুনির ভই ডিমান্ড নোট বিক্রির গল্পটা বলা বন্ধ করবেন। কারণ তার বন্ধু হতদরিদ্র কেউ ছিল না যাকে জীবন বাঁচানোর জন্য দেশের আইন ভাঙ্গতে হবে। বরং তার সেই বন্ধুটি পরবর্তীতে আরো অনেক আইন ভেঙ্গেছেন এই যুক্তিতে যে, এতে অন্যের কোন ক্ষতি হচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলি। আমি ১৯৯০ সাল থেকে এনজিওদের সঙ্গে কাজ করছি। দেশী বিদেশী সকল ধরনের এনজিও এবং দাতা সংস্থার সঙ্গে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। আমি অনেক এনজিও নেতাকে প্রজেক্টের অর্থ পকেটস্থ করার পক্ষে যুক্তি দিতে শুনেছি- বিদেশ থেকে এই টাকা তো প্রজেক্ট প্রোপজাল লিখে আমিই আনলাম। এখন যতটুকু এলাকায় খরচ করেছি তাতেই তো খুশি হওয়া উচিৎ। আমি না আনলে তো এটুকুও এলাকার মানুষ পেতো না।

অন্যায়কারীদের যুক্তির অভাব হয় না। অন্যায়ের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে অনেকে স্বাধীনতাকে টেনে আনেন। এদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। তবে আজকে তেমন একজন অনুষ্ঠানে ছিলেন। যিনি পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সঙ্গে বাংলাদেশের কয়েকজন ব্যক্তির জীবনের সমস্যা ও আইন ভঙ্গকে গুলিয়ে ফেলেছেন। ছোট অন্যায়কারী ও বড় অন্যায়কারী সকলেরই যুক্তি আছে। কিন্তু অন্যায় অন্যায়ই। পুঁজি বাজার থেকে যারা অর্থ লুটপাট করেছে তারা এটাকে তাদের মেধার উপযুক্ত ব্যবহার ও অন্যদিকে বোকা বিনিয়োগকারীদের লোভের খেসারত হিসেবে দেখছে। গড ফাদার মুভিতে বিজনেসের জন্য খুনও চলে বলে যুক্তি দেওয়া হয়। তাই শুধুমাত্র ভালোবাসা ও যুদ্ধ নয় বিজনেসেও আনফেয়ার বলে কিছু নেই অনেকে বলে থাকেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই মতবাদে বিশ্বাসী নই। মুনির ভাই যদি বিশ্বাসী হন তবে সেটা তাকে সুস্পষ্ট করতে হবে। তার বন্ধু যে অপরাধ করেছে তার সঙ্গে এরশাদের অপরাধের তফাত হলো এরশাদ আরো বড় অপরাধ করার সুযোগ পেয়েছে ও করেছে। সুযোগের অভাবে ভালো থাকাটা কোন প্রকৃত ভালো থাকা নয়।

এবার প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের আয়োজনের দুয়েকটি দিক নিয়ে কথা বলি।

ব্যানারে লেখা ছিল আধুনিক পেশাজীবি ও উদ্যেক্তা তৈরি: জেলা পরযায়ের কর্মকান্ডের অবহিতকরণ ও মতবিনিময় সভা। কিন্তু সেই অর্থে তেমন কিছু জানা যায়নি। মোট সময়ের দশ ভাগের এক ভাগ সময়ও এই বিষয়ে খরচ করা হয়নি। সেকারণে খুব একটা জানতে পারিনি সত্যি সত্যি জেলা পরযায়ে আধুনিক পেশাজীবি ও উদ্যেক্তা তৈরির বিষয়টি কেমন আগাচ্ছে। হয়তো অন্য কোন সময় জানা যাবে।

অনুষ্ঠানে অনেক তরুণ এসেছিল। সে তুলনায় তরুণীদের উপস্থিতি ঘটেনি। দেশের সত্যিকারের উন্নয়নের ছেলে ও মেয়ে উভয়ের উপস্থিতি দরকার রয়েছে। আজকেই আমি প্রথম প্রযু্ক্তিতে বাংলাদেশ অফিসে গিয়েছি। অন্য অনুষ্ঠানগুলোতে হয়তো মেয়েদের উপস্থিতি থাকে।

ফ্রিল্যান্স শব্দটাকে অনুষ্ঠানের চারদেওয়ালের মধ্যে থাকা মানুষগুলো ইন্টারনেটভিত্তিক কাজের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেছে দেখলাম। অনেকটা আইবিএম এর পিসির মতো। কিংবা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট বা ক্রিস্টালের গ্লাসের মতো। আমি ২০০৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০১২ সালের জানুয়ারি পরযন্ত যে ফ্রিল্যান্স কাজ করলাম সেটা কিন্তু সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন কিংবা প্রযুক্তির কিছু নয়। এই সময়ে আমি প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কখনো প্রশিক্ষণ, কখনো কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট, কখনো কমিউনিকেশন স্ট্যাটিজি কিংবা অন্য কিছু করেছি। ফ্রিল্যান্স শব্দটা হলো মুক্ত পেশাজীবি। যিনি কারো পে রোলে নেই। এই ধারণাটা পরিস্কার হওয়া দরকার। সেসঙ্গে একথাটাও প্রযুক্তিতে বাংলাদেশকে বুঝতে হবে  দেশের সত্যিকারের উন্নয়নে দেশের প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহারের উপর নির্ভর করছে। প্রযুক্তি উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি হাতিয়ার মাত্র। মূল চালিকাশক্তি নয়।

(এটি একটি অসমাপ্ত লেখা)

13 thoughts on “মুনির হাসানের ডিমান্ড নোট বিক্রির গল্প, প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ এবং এক সন্ধ্যা

  1. আপনার অসমাপ্ত লেখার ব্যাপারটা আমার পছন্দ নয়। মুনির হাসানের বন্ধুটির যেমন জীবন ধারনের জন্য অন্যায় করবার প্রয়োজন ছিলো না, তেমন আপনারও এই লেখাটি (অন্য কিছু লেখাসহ) অসমাপ্ত রাখার দরকার ছিলো না।
    পাঠকের প্রতি আপনার কিছু দায়িত্ব আছে, পাঠকেরও আপনার প্রতি তেমন দাবী আছে, ভবিষ্যতে এমন সব অসমাপ্ত লেখার জন্য অগ্রিম ভর্ৎসনা জানিয়ে গেলাম… 🙂

  2. স্যার এইও গল্পটা আমি প্রথম শুনেছিলাম বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এক আই সি টি ফেয়ারের এক সেমিনারে…
    আপনার লেখাটা তাড়াতাড়ি শেষ করেন…অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।।

  3. ধন্যবাদ আপনাকে,চমৎকার একটা লেখার জন্য। যথেষ্ট পরিমান যুক্তি যুক্ত লিখা, ভাল না লেগে উপায় নেই। আশা করছি, দ্রুত ই বাকী অংশ পড়তে পারব।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান